উপকূলীয় অঞ্চলের দুঃখ ‘নদীভাঙন’

উপকূলীয় অঞ্চলের দুঃখ ‘নদীভাঙন’

উপকূলীয় অঞ্চলের দুঃখ ‘নদীভাঙন’

আওছাফুর রহমান

সাগরে নিম্নচাপ, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, টানা বৃষ্টি আর ঝড়ো বাতাস উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের দুশ্চিন্তা বাড়ায়। কারণ একদিকে নিম্নচাপ ও বৃষ্টিতে উপকূলীয় এলাকায় নদ-নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে ঝড়ো বাতাসে নদীর স্রোতের গতি বৃদ্ধি পায়। তখন বেড়িবাঁধ ভেঙে অথবা উপচে প্লাবিত হয় লোকালয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের জলাশয়, ফসলের মাঠ ও ঘরবাড়ি। তাই উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের বড়ো দুঃখ ‘নদীভাঙন’।

বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা নিয়ে বৃহত্তর খুলনাঞ্চল গঠিত। তবে সুন্দরবন সংলগ্ন এসব জেলাগুলোর মধ্যে আতঙ্কে দিনযাপন করেন খুলনার কয়রা উপজেলার এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মানুষ। কারণ এসব এলাকায় নদীভাঙন একটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। নদীর পানি বাড়লে বেড়িবাঁধ ভেঙে ওই এলাকার লোকালয় প্লাবিত হয়। তখন শত শত পরিবার মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হয়। খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। বিগত দিনে আঘাত হানা আইলা, সিডর, আম্ফানে বিধ্বস্ত মানুষ আজও উঠে দাঁড়াতে পারেনি।

এলাকাবাসীর ভাষ্য অনুযায়ী, সাগরে নিম্নচাপ সৃষ্টি হলে আকাশ অধিকাংশ সময়ই মেঘাচ্ছন্ন থাকে। তখন উপকূলবর্তী এলাকায় নদীর পানি স্বাভাবিকের তুলনায় ৩ থেকে ৪ ফুট উচ্চতায় বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত পানির চাপে ভেঙে যায় এসব অঞ্চলের নড়বড়ে বেড়িবাঁধ। যার ফলে প্লাবিত হয় মৎস্য ঘের, পুকুর, রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি। পানিবদ্ধতায় স্থবির হয়ে পড়ে জীবনযাত্রা।এছাড়া অতিবৃষ্টি ও নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে জলাবদ্ধতায় উপকূল এলাকায় মানুষ খাবার পানির চরম সংকটে ভোগে। আবার লোকালয়ে লবনাক্ত পানির প্রবেশ করায় মাছ ও অন্যান্য প্রাণী মারা যায়। যেগুলো পচে দুর্গন্ধ ও নানান ধরনের জীবাণু সৃষ্টি হয়। ফলে মানুষ টাইফয়েড জ্বর, রক্ত আমাশয়, ডায়রিয়া, কলেরা ও চর্মরোগসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়। এমনকি ছোট ছেলেমেয়ে ও পরিবারের বৃদ্ধদের নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তরিত করতেও বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হয়।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ২৫ মে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলায় দক্ষিণ জনপদের উপকূলীয় অঞ্চল লন্ডভন্ড হয়ে যায়। এতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় দক্ষিণ উপকূলীয় বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী সুন্দরবনের কোলঘেঁষা খুলনা জেলার কয়রা উপজেলা ও সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা। এসব এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোনা পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়া নদীতে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি সব বিলীন হয়ে যায়। ফলে ফসলশূন্য হয়ে উঠে এসব এলাকা। সে সময় কয়েক হাজার পরিবার বেড়িবাঁধের ওপর মানবেতর জীবনযাপনও করেছে।

অন্যদিকে আইলার ক্ষত না শুকাইতে আম্ফানের তাণ্ডবে লণ্ডভণ্ড হয় শ্যামনগর ও কয়রা। এ সময় পানিবন্দি হয়ে পড়ে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ। ঘরবাড়ি ধসে পড়ে ২ হাজারেরও বেশি। এতে মাছের ক্ষতি হয় ১৭৬ কোটি ৩ লাখ টাকার। কৃষিতে মোট ক্ষতি হয় ১৩৭ কোটি ৬১ লাখ ৩০ হাজার টাকার। এলজিইডি ও সড়ক বিভাগের ক্ষতি হয় কমপক্ষে ৩০ কিলোমিটার সড়ক। এছাড়া কয়রার চারটি ইউনিয়নের ৫২টি গ্রাম সম্পূর্ণ এবং দু’টি ইউনিয়নের ২৪টি গ্রাম আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২১টি স্থানে বাঁধ ভেঙ্গে যায়। ৫১ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে এক লাখ ৮২ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’

সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্য মতে, গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে কয়রা উপজেলার শাকবাড়ীয়া নদীর পাউবোর বাঁধের ১৪/১ নম্বর পোল্ডারের ১০০ মিটার অংশে ছোট-বড় অনেক ফাটল ও ধস দেখা দিয়েছে। জোড়শিং এলাকার অংশটুকু বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। ফলে ভাঙন হুমকিতে পড়েছে বাঁধসংলগ্ন জোড়শিং, আংটিহারা, গোলখালি ও বিনাপানি গ্রামসহ দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার মানুষ। ভাঙনরোধে পাউবোর পক্ষ থেকে দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে প্রায় ২ হাজার একর আমন খেতসহ অসংখ্য মাছের ঘের নদীর লোনাপানিতে ডুবে যাওয়ায় আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

সবমিলিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ, খাবার পানির সংকট নিরসন ও নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা জোরদার করতে সরকারকে আরো বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় আরো বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে; তা না হলে মানচিত্র থেকে এসব অঞ্চল অতিদ্রুত বিলীন হয়ে যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *