অগ্নিঝরা  মার্চ ও স্বাধীনতার মহানায়ক

ইলিয়াস সানী

পাকিস্তান সৃষ্টির পর বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেন এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয়নি, এখানে বাঙালির স্বার্থ কখনোই রক্ষা হবে না। বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ে ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, তিনি চেয়েছিলেন একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু জীবনেরও ১৩টি মূল্যবান বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন ও বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ ২৪টি বছর  অপেক্ষা করতে হয়েছে। পাকিস্তানের তেইশ বছরে প্রথম প্রত্যক্ষ ভোটে দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত ১৯৭০ এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নির্বাচন সম্পন্ন হলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের জন্য জোর দেন। অন্যদিকে ক্ষমতালোলুপ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভুট্টো এজন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন ও অধিবেশনকে বিলম্বিত করবার কৌশল গ্রহণ করেন। ১ মার্চ ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিষদ অধিবেশন পিছিয়ে দিলেন এবং একই সঙ্গে ইয়াহিয়া সামরিক শাসনের কড়াকড়ি প্রয়োগ করলেন। ইয়াহিয়া ভালোভাবেই জানতেন যে অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন মুলতবি করা মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না, কিন্তু সামরিক অপারেশনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য তাঁর এটা প্রয়োজন ছিল। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে ইয়াহিয়া পাকিস্তানের কবর রচনা করলেন। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান ইয়াহিয়ার এই ঘোষণায় ক্ষোভ ও ক্রোধে ফেটে পড়লো। বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করলেন। তিনি ৩ মার্চ হরতাল ঘোষণা করলেন এবং জানালেন যে, ৭ মার্চে একটি জনসভায় তিনি পরবর্তী কার্যক্রম ঘোষণা করবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একদিকে ইয়াহিয়াকে শোধরানোর সময় দিলেন, অন্যদিকে নিজের রাস্তা ঠিক করবার জন্যও সময় নিলেন। ইয়াহিয়া জান্তার উদ্দেশ্য ছিল যে করেই হোক পূর্ব পাকিস্তানকে ক্ষমতাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত করা। আওয়ামী লীগের বিজয়ের পর থেকেই তাদের চক্রান্ত শুরু হয়। তারা প্রথমে শেখ মুজিবকে নমনীয় করবার চেষ্টা চালায়। সেই অভিযান ব্যর্থ হলে তারা সামরিক অপারেশনের পরিকল্পনা করে। এই অভিযান শুরু করার জন্য বাহানার প্রয়োজন পড়ে এবং তারা নিশ্চিত ছিল যে, অধিবেশন স্থগিত করলে যে প্রতিবাদ ও আক্রোশ ফেটে পড়বে তারই সুযোগ নিয়ে অপারেশন চালানো যাবে। তাদের হিসেবে একটিই ভুল ছিল। তারা ভাবে নি সামরিক অপারেশন একটি মুক্তিযুদ্ধের সূচনা করবে। বাঙালিরা যে অস্ত্র ধরবে আত্মদর্পী ও উন্মত্ত ইয়াহিয়া জান্তা তা কল্পনাও করতে পারে নি।

আওয়ামী লীগ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের বা প্রথম পঁচিশ দিন বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। আন্দোলনটি ছিল সর্বজনীন ও স্বতঃস্ফূর্ত।বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্ব ক্ষমতা প্রয়োগের সংযম ও সহনশীলতার আদর্শ সমুন্নত করে। বস্তুতপক্ষে মার্চ মাসের প্রথম পঁচিশ দিনেই মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী কর্মসূচি, ধারা ও গতি নির্ধারিত হয়ে যায়। অবশেষে এলো ৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধুর জীবনেরও সম্ভবত শ্রেষ্ঠ ভাষণ তিনি দিয়েছিলেন ৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দশ লাখ মুক্তিকামী বাঙালির সামনে। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বিগত ২৩ বছরের বঞ্চনার ইতিহাস, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ এর নির্বাচন, ১৯৫৮ এর সামরিক শাসন, ১৯৬৬ এর ছয় দফা, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ এর নির্বাচনসহ তৎকালীন পাকিস্তানে বাঙালি বঞ্চনার কথা জানিয়েছেন, অন্যদিকে যুদ্ধকৌশলও বলে দিয়েছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, যদি যুদ্ধ হয় তবে বাঙালিরা যেন বর্ষাকালকে বেছে নেয় যুদ্ধের জন্য। কিন্তু পাকিস্তানিরা এ বক্তৃতার সারমর্ম বুঝতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের রেসকোর্সে ভাষণ দেয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তিনি বলতে গেলে শত্রুর ঘাঁটির মাঝে বসে জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করার ঘোষণা দিলেন। কারণ রেসকোর্স ময়দান থেকে ক্যান্টনমেন্ট মাত্র পাথর ছোঁড়ার দূরত্বে ছিল, বেখাপ্পা কিছু বললেই তাঁর সাথে সাথে লাখ লাখ বাঙালিকে পাকিস্তানিরা নিঃশেষ করে দিতে পারে। তিনি নিপুণ কৌশলের সহিত শত্রুর বিরুদ্ধে জনগণকে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিলেন, আর বাঙালিদের তা বুঝে নিতে ভুল হয়নি।

২৫ শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে বাঙালি নিধনযজ্ঞের সবুজ সংকেত প্রদান করে সন্ধ্যায় গোপনে পশ্চিম পাকিস্তান যাত্রা করে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিদের উপরে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়, গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দানবরা মেতে উঠেছিল নির্বিচারে স্বাধীনতাকামী বাঙালি নিধনযজ্ঞে। এক ভয়ঙ্কর, নৃশংস ও বিভীষিকাময় রাত ছিল সেটা বাঙালির জীবনে। রাত সাড়ে ১১ টায় ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হল হনন-উদ্যত নরঘাতক কাপুরুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, ছড়িয়ে পড়ল শহরময়। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গর্জে উঠল অত্যাধুনিক রাইফেল, মেশিন গান ও মর্টার। রাতের আধারে চলল বর্বরিত নিধনযজ্ঞে আর ধ্বংসের উন্মত্ততা। হকচকিত বাঙালি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। মধ্যরাতে ঢাকা হয় উঠল লাশের শহর। একাত্তরের ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানেই মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক ঘুমন্ত বাঙালিকে। গ্রেপ্তারের ঠিক আগ মুহুর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন গোপন ওয়ারলেস বার্তায়। স্বাধীনতা ঘোষণার মুহূর্তের সাক্ষী মেজর সালেক সিদ্দিক তাঁর বই Witness of Surrender এ স্বাধীনতা ঘোষণার মুহূর্তটি তুলে ধরেছেন এভাবে-“When the first shot had been fired, ‘the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, sounded like a prerecorded message, the Sheikh Mujibur Rahman proclaimed East Pakistan to be the People’s Republic of Bangladesh. The full text of the proclamation is published in Bangladesh Documents released by the Indian Foreign Ministry. It said, This may be my last message. From today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh, wherever you are and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.”

বঙ্গবন্ধু কখনোই আক্রমণকারী হতে চাননি, চেয়েছিলেন আক্রান্ত হতে। অবশেষে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন, প্রবল চাপের মুখেও পরম ধৈর্য্যে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ থেকে  ১৮ দিনের প্রতিটি প্রহর অপেক্ষা করেছেন ২৬শে মার্চের সেই সঠিকক্ষণটির জন্য। সেজন্যই ২৫ মার্চের শেষ রাতে এবং ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে যখন অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে, ঠিক তার পরপরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর শেষ বার্তায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’।বঙ্গবন্ধুর ডাকে সব এক হয়ে গেল, কে রুশপন্থী, কে চীনপন্থী, কে আওয়ামী লীগ কিংবা কে নীরব মুসলিম লীগ-সব একাকার। সবার সামনে একটাই গন্তব্য-স্বাধীনতা। অবশেষে নয় মাস জনযুদ্ধ ও গেরিলাযুদ্ধের পথ অনুসরণ করে ৩০ লক্ষাধিক প্রাণ আর ৪ লক্ষাধিক মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জিত হল ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরে।

লেখকঃ ইলিয়াস সানী, প্রভাষক, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলতুন্নেসা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *