নৌকা যেভাবে বাংলার নির্বাচনে

নৌকা যেভাবে বাংলার নির্বাচনে: স্বায়ত্ত্বশাসন, স্বাধীনতা ও উন্নয়নের বিমূর্ত প্রতীক হিসেবে (১৯৪৩-২০২৪)
  • নৌকা যেভাবে বাংলার নির্বাচনে: স্বায়ত্ত্বশাসন, স্বাধীনতা ও উন্নয়নের বিমূর্ত প্রতীক হিসেবে (১৯৪৩-২০২৪)

অধ্যাপক ড. মোঃ শাহেদুর রশিদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৪৩-এর মাঝামাঝি বাংলায় মহাদুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষে গোপালগঞ্জে সাহায্য আনার জন্য মুসলিম লীগের জাতীয় নেতাদের নিয়ে নিজের এলাকায় একটা সম্মেলনের আয়োজন করেন তখনকার তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বড় বড় নৌকার বাদাম দিয়ে সম্মেলনের প্যান্ডেল করেছিলেন তিনি। প্যান্ডেলে নৌকার একটি অনুষঙ্গ ব্যবহারের এই ধারণাটা ছিল অভিনব ও জনপ্রিয়। এরপর আওয়ামী লীগের বহু অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জাতেই অব্যাহতভাবে ব্যবহার করেছে নৌকা।

প্রকৃতপক্ষে, নৌকা ঐতিহাসিকভাবে পূর্ববঙ্গের প্রতীক। প্রাচীনকাল থেকেই নদীমাতৃক বাংলায় নদীপথ ছাড়া চলাচলের কোন উপায় ছিল না। নদীতে নৌকা মানেই পালতোলা নৌকা। নদী আর নৌকা নিয়েই ঐতিহ্যবাহী গান ও সুসমৃদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা হতো পূর্ববঙ্গে। এই প্রতীকটা তাই ঐতিহ্যগতভাবে এই অঞ্চলের মানুষের মননে এবং পরবর্তীতে রাজনৈতিক অঙ্গনেও প্রোথিত হয়ে গেছে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল ও পাকিস্তান খেলাফত পার্টির সঙ্গে মিলে ১৯৫৩ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। শরিক হিসেবে যুক্তফ্রন্টে আরও ছিল মাওলানা আতাহার আলীর নেজামে ইসলাম পার্টি, বামপন্থী গণতন্ত্রী দলের নেতা ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলী সিলেটী। যুক্তফ্রন্ট উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথমে ভোটের লড়াই শুরু করে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে, ইশতেহারে স্বায়ত্তশাসন ছিল অন্যতম দাবি। সেই সময় যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় শরিক দল ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ।

১৯৫৪ সালের ৮ই থেকে ১২ই মার্চ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান পরিষদের নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থীরা ২২৩টি আসনে বিজয়ী হন। এর মধ্যে ১৪৩টি পেয়েছিল মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ, ৪৮টি পেয়েছিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামী ইসলাম পার্টি জয়ী হয় ২২টি আসনে; এ ছাড়া গণতন্ত্রী দল ১৩টি এবং খেলাফত-ই-রাব্বানী দুটি আসনে জয়ী হয়।

ঐ সময়ে* দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, নৌকা প্রতীক ও স্বায়ত্তশাসন বিষয়ে তিনি জোরালো ভূমিকা রাখেন। নির্বাচনের পর ১০ই মে ১৯৫৪ তিনি ‘কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন’ মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থী ওহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়াকে পরাজিত করে প্রথমবারের মত প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন।

১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ যুক্তফ্রন্ট ভেঙে গেলে জোটের সবচেয়ে বড় দল এবং নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসনজয়ী হিসেবে নৌকা প্রতীক আওয়ামী মুসলিম লীগেরই থেকে যায় । এর পরপরই ১৯৫৫ সালের ২১-২৩শে অক্টোবর কাউন্সিলের মাধ্যমে আওয়ামী মুসলিম লীগ ‘মুসলিম’ শব্দটি পরিত্যাগ করে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, ফলে অমুসলিমরাও দলে যোগ দেয়ার সুযোগ পায়।

বাস্তবে নৌকায় চড়ে এককভাবে নির্বাচন করতে আওয়ামী লীগকে অপেক্ষা করতে হয় সুদীর্ঘ আরও প্রায় দেড় দশক। পাকিস্তানের ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নৌকা প্রতীক নিয়ে অংশগ্রহণ করে সাধারণ পরিষদে ১৬০ এবং প্রাদেশিক পরিষদে ২৮৮ আসনে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। সেই থেকে আজ অবধি নৌকাতেই চড়ে এগিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ।

  • এখন জাতীয় নির্বাচনে নৌকার উত্থান ও ধারাবাহিকতা সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করা হলো:
  • পূর্ববঙ্গ আইনসভা নির্বাচন, ১৯৫৪: নেতা: মাওলানা হামিদ খান ভাসানী। প্রতীক: নৌকা। দল: আওয়ামী মুসলিম লীগ (যুক্তফ্রন্টের অধীনে)। মোট আসন: ২৩৭ (মুসলিম আসন)। প্রাপ্ত আসন: ১৪৩। (যুক্তফ্রন্ট মোট ২২৩)। অনুষ্ঠিত: ৮ থেকে ১২ই মার্চ ১৯৫৪।
  • পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন, ১৯৭০: নেতা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতীক: নৌকা। দল: আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০ (পূর্ব পাকিস্তান)। প্রাপ্ত আসন: ২৮৮। অনুষ্ঠিত: ৭ই ও ১৭ই ডিসেম্বর ১৯৭০।
  • বাংলাদেশ গণপরিষদ গঠন, ১৯৭২: নেতা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৪০৩। প্রাপ্ত আসন: ৪০০। অনুষ্ঠিত: ১১ই জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখে জারিকৃত “বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ, ১৯৭২” অনুযায়ী।
  • প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৭৩: নেতা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০।প্রাপ্ত আসন: ২৯৩। অনুষ্ঠিত: ৭ই মার্চ ১৯৭৩।
  • দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৭৯: নেতা: আসাদুজ্জামান খান। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: ৩৯। অনুষ্ঠিত: ১৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯।
  • তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৮৬: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: ৭৬। অনুষ্ঠিত: ৭ই মে ১৯৮৬।
  • চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৮৮: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা (ব্যবহৃত হয় নি)। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (নির্বাচন বর্জন করে)। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: প্রযোজ্য নয়। অনুষ্ঠিত: ৩রা মার্চ ১৯৮৮।
  • পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯১: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: ৮৮। অনুষ্ঠিত: ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৯১।
  • ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা (ব্যবহৃত হয় নি)। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ (নির্বাচন বর্জন করে)। মোট আসন: ২৮৯ (অবশিষ্ট অসমাপ্ত/স্থগিত)। প্রাপ্ত আসন: প্রযোজ্য নয়। অনুষ্ঠিত: ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬।
  • সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ১৯৯৬: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: ১৪৬। অনুষ্ঠিত: ১২ই জুন ১৯৯৬।
  • অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০০১: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: ৬২। অনুষ্ঠিত: ১লা অক্টোবর ২০০১।
  • নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০০৮: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: ২৩০। অনুষ্ঠিত: ২৯শে ডিসেম্বর ২০০৮।
  • দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৪: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: ২৩৪। অনুষ্ঠিত: ৫ই জানুয়ারি ২০১৪।
  • একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০১৮: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: ২৫৭। অনুষ্ঠিত: ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৮।
  • দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন, ২০২৪: নেতা: জননেত্রী শেখ হাসিনা। প্রতীক: নৌকা। দল: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। মোট আসন: ৩০০। প্রাপ্ত আসন: নির্বাচনের পর জানা যাবে। অনুষ্ঠিতব্য: ৭ই জানুয়ারি ২০২৪।

লাল-সবুজ পতাকা, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুর সাথে নৌকা মার্কাও প্রায় সমার্থক হিসেবে বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে সমাদৃত অনুষঙ্গ। ভবিষ্যতেও বাংলার বৈচিত্র্যময় অঙ্গনে, উন্নয়নে ও জাতীয় নির্বাচনে এই নৌকা বঙ্গবন্ধুর কন্যা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেও তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রেখেছে এবং রাখবে, নিঃসন্দেহে, সদর্পে পাল তুলে।

অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *